মহান আল্লাহ প্রতিটি বিধান পালনের জন্য আখিরাতে
তাঁর বান্দাদের জন্য রেখেছেন রাশি রাশি পুরষ্কার । ফুলে ফুলে সুখময় করে ভরিয়ে
দেবেন নেককার বান্দাদের পরকালীন জীবন ।
সিয়াম সাধনার জন্য জান্নাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে
রাইয়ান নামক একটি তোরণ । সে তোরণ দিয়ে কেবল সিয়াম সাধনায় লিপ্ত বান্দাগণই প্রবেশ
করতে পারবেন। অন্যরা এতে প্রবেশাধিকার পাবে না।
তেমনি মাহে রামাজানের সম্মানে আল্লাহ তা’আলা
জান্নাতের সবগুলো দরজা উম্মুক্ত করে দেন। রামাজানের প্রতিটি আমলের প্রাপ্তিকে
আল্লাহপাক জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি করে দেন। এ সিয়াম সাধনার ছওয়াব ও গুরুত্ব এত অধিক
যে, এর জন্য আল্লাহ তাঁর নিজ হাতে বান্দাদের পুরস্কার প্রদান করবেন। এভাবে যাবতীয়
আমলে মুমিনদের মূল লক্ষ্য আখিরাত। সেখানের সফলতাই প্রকৃত সফলতা। তাই মুমিন দুনিয়ার লোভ কিংবা লাভের জন্য কোন আমল করে না
অথবা করবেনা।
তবুও এ কথা দিবালকের ন্যায় স্পষ্ট যে, মহান আল্লাহর
প্রতিটি বিধানের মধ্যে বিদ্যমান থাকে দুনিয়া ও আখিরাতের মহাকল্যান । যেহেতু আল্লহ
সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, সেহেতু তিনি এর কল্যান-আকল্যান সম্পকে সাম্যক অবহিত । আর
অবহিত বলে আল্লাহর আদেশ-নিষেদ কল্যান থাকা যৌক্তিক । শুধু যৌক্তিক নয়; বিভিন্নভাবে
রিচার্সে এখন এ সত্য বারংবার প্রমানিত হচ্ছে ।
যেমন, সিয়াম সাধনা বা রোযা । এটা মহামহীয়ানের এক
ইবাদতের নাম । এ ইবাদতে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হয় । পানাহার-যৌনচার থেকে বিরত
থাকতে হয় । রাতে তারাবীহ নামায আদয় করতে হয় ইত্যাদি । যা খুবই কষ্টকর । অথচ এ
কষ্টের মাঝে রয়েছে বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতের অফুরন্ত কল্যাণ ।
সিয়াম সাধনা
স্বাস্হের জন্য কতটা উপকারী, তা চিন্তা করলে অবাক হতে হয় । তার একটি
সংক্ষিপ্ত তাত্ত্বিক আলোচনা নিম্নে উপস্হাপন করা হলো ।
স্হুলতা রোগে (Fatty person)
রোযা দ্বারা সবথেকে লাভবান হন স্হুলকায় লোকেরা ।
সমাজে কিছু কিছু লোক আছেন, যাদের কাছে অতিভোজন খুবই প্রিয় । বার বার খাওয়া এদের
অভ্যাসগত । এভাবে বার বার খেতে খেতে তাদের শরীরে চর্বির পাহাড় জমা হয় । ফলে একসময়
তারা অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যান ।
জমাকৃত এই চর্বি যে কেবল চামড়ায় নিচে জমা হয় তা নয়;
বরং এই চর্বি কলেস্টেরল (Cholesterol) আকারে শিরা-উপশিরা (Arterus and
Arterioues), ধমনী (Veins) এবং হ্দদপিন্ডে (Heart) জমা হয় । ফলে এতে তাদের শরীরের
স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়।
শিরীরের শিরাগুলো হ্দদপিন্ড থেকে বিশুদ্ধ রক্ত বহন
করে টিসুর দিকে নিয়ে যায়, সেখানে এই রক্ত আবার বিশুদ্ধ হয় । এভাবে রক্তের
সার্কুলেশানকে নদী-নালার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে । কিন্তু এই নদী নালার তলদেশে
যদি বালি বা পলি জমে, তখন নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় অধিক পানি ঐ নদী দিয়ে আর প্রবাহিত
হতে পারে না । তেমনি শীররের রক্তে বেশি কলেস্টেরল জমা হলে, শিরা-উপশিরার ভিতরের
লাইনিংয়ে (Inner lining) তা জমা হয়ে এগুলোর গভীরতা কমিয়ে ফেলে । যার জন্য পর্যাপ্ত
কিংবা প্রয়োজনীয় রক্ত চলাচল করতে সক্ষম হয় না । ফলে একদিকে উচ্চ রক্তচাপের (High
blood pressure) সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে শরীরের টিসুগুলো ঠিকমত পুষ্টি পায় না । সে
জন্য মারাত্নক রোগে আ হয়ে পড়ে ।
এ ধরনের স্হুলকায় লোক বা রোগীদের জন্য রামাজানের
রোযা অত্যন্ত উপকারী । আবশ্যক ও বটে । রোজা রাখার কারনে 14/15 ঘন্টা সব ধরনের
খাবার গ্রহন নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ফলে শরীরের জমানো কলেস্টেরলগুলো শরীরের প্রওয়োজনীয়
কাজে ব্যবহ্ত হয়ে এর পরিমান কমে যায় । আর এটা দীর্ঘদিন তথা 29/30 দিন হওয়াতে
রক্তের সার্কুলেশন আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে । ফলে রোযা রাখার কারনে স্হুলতার
কুপ্রভাব লাঘব হয় এবং স্বাস্হ্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্হায় চলে আসে ।
পেপটিক আলসার (peptic ulcer)
রোযা রাখা বা না রাখার ব্যাপারে এ রোগটির নাম বেশ
শোনা যায়। প্রথমে এ রোগ সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যেতে পারে। পেপটিক আলসার (peptic
ulcer) বলতে দু’টি অসুখকে বুঝানো হয়। একটি হচ্ছে গ্যাস্ট্রিক আলসার (Gastric
Ulcer) আর অপরটি হচ্ছে ডিউডেনাল আলসার (Duodenal Ulcer)। স্টমাক এ ঘা হলে তাকে বলে
গ্যাষ্ট্রিক আলসার; তার স্টমাকের পরেই যে ক্ষুদ্র অন্ত্র থাকে, তাকে বলে ডিউডেনাল
আলসার। অনেকের ধারণা, পেপটিক আলসার রোগীদের রোযা রাখা সম্ভব নয়। ধারণার কিছু অংশ
সত্য, বাকি প্রায় সবটুকু সত্য নয়। একটু ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে ব্যাপারটি পরিষ্কার
হয়ে যাবে আশা করি।
এ ধরণের রোগীরা ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তাদের
প্রশ্ন করেন- ব্যথা খেলে বাড়ে, না ক্ষুদা লাগলে বাড়ে? যদি রোগী খেলে ব্যথা বাড়ে
বলে, তবে এটা হচ্ছে গ্যাষ্ট্রিক আলসার। আর যদি রোগীর ক্ষুদা লাগলে বাড়ে, তবে এটা হচ্ছে
ডিউডেনাল আলসার।
যাদের গ্যাষ্ট্রিক আলসার আছে, তাদের জন্য সিয়াম
সাধনা বিশেষ উপকারী। কেননা, এ রোগ খেলে বাড়ে। অর্থাৎ না খেলে রোগের উপশম হয়। কারণ
দীর্ঘ সময় পাকস্থলী বিশ্রাম পেয়ে থাকে।
কিন্তু ডিউডেনাল আলসারের বেলায় দীর্ঘ সময় অনাহারের
ফলে রোগ বৃদ্ধি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগী যদি নিশ্চিত থাকে যে, তার ব্যথা তীব্র
হয়ে যাবে এবং কোনভাবেই রোযা রাখা সম্ভব নয়, তাহলে এর জন্য ইসলামের বিধান মতে
অসুস্থতা থাকা পর্যন্ত রোযা ভাঙ্গা জায়িয আছে। সুস্থ হলে পরবর্তীতে এ রোযাসমূহে
কাজা আদায় করতে হবে। তবে রোগটি যদি এত মারাত্মক হয় যে, কোনভাবেই জীবদ্দশায় কখনো
রোযা রাখা সম্ভব নয়, তাহলে ইসলামের বিধান হচ্ছে- প্রতি রোযার পরিবর্তে একজন
মিসকীনকে দু’বেলা পেট পুরে খাবার দিতে হবে, অথবা পৌনে দু’সের গম (অথবা তার মূল্য)
ফকির-মিসকীনকে দান করতে হবে। অবশ্য এরপর কখনো সুস্থতা ফিরে এলে, ফিদইয়া প্রদান
স্বত্ত্বেও সেই রোযাগুলোর কাজা আদায় করতে হবে।
তবে বাস্তবতা হল, আল্লাহকে খুশী করার জন্য অনেক দৃঢ়
ঈমানদার ব্যক্তি শক্তিশালী মনোবল (Strong will-force) থাকার কারণে ডিউডেনাল আলসার
নিয়েও সিয়াম পালন করেন। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের পরামর্শ হচ্ছে- নিয়মিত ঔষধ (ল্যাকটামিল)
সেবন করতে হবে। সে সাথে দুইবার তথা সাহরী ও ইফতারীর সময় দুধ সেবন করতে হবে। কারণ,
দুধ এ রোগের জন্য খুবই উপকারী।
উল্লেখ্য যে, চিকিৎসকগণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে,
রোযা রাখা অবস্থায় সাধারণত এসব রোগীর এ রোগের কারণে মৃত্যু হয় না। দু’-একটা যা হয়,
তা ইফতারীর পর হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে অথবা তারাবীহ নামাযের পর অন্যকোন
অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য হয়ে থাকে। সুতরাং এ জাতীয় রোগীর জন্য মেডিক্যাল সাইন্সের
উপদেশ হলো- ইফতারীর আইটেম কমাতে হবে। অর্থাৎ স্বল্প পরিমাণে ইফতার করতে হবে এবং
চর্বিযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করতে হবে। আর ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী
নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। এরপর প্রয়োজনীয় সময় বিশ্রাম নিয়ে জামা’আতের সাথে
তারাবীহ আদায় করতে হবে। এতে অক্ষম হলে একাকি বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে ধীরে-সুস্থে
তারাবীহ আদায় করতে হবে।
লিখক- মাওলানা
খালিদ সাইফুল্লাহ
সম্পাদনায়- R.Hossain