সন্তান মাতা ও পিতার নিকট মহান আল্লাহর গচ্ছিত অতিবৃহৎ একটি আমানত। একদিকে সন্তানদের লালন-পালন করা এবং তাদের দেহ-মনের যত্ন করে সুস্থ ও সতেজ রাখা পিতা-মাতার কর্তব্য, অপরদিকে সন্তানদের আত্মার প্রতিপালন তথা সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে দ্বীনদার রূপে গড়ে তোলা পিতা-মাতার এক মহান দায়িত্ব।
সন্তান জন্মের পর তার ব্যাপারে পিতা-মাতা বা অভিভাবকের কিছু দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক হয়। এটা সন্তানের হক ও সুন্নাত আমল। নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হল-
1. তার ডান কানে আজান বা বাম কানে ইকামাত দেয়া: সন্তান
ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে তার কানে অন্যকোন কথা বা শব্দ প্রবেশ করার পূর্বেই মহান
আল্লাহর নাম তার কানে প্রবেশ করানো প্রয়োজন। এ জন্য ধাত্রী আউযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ
পড়তে পড়তে প্রসূত শিশুকে ঈষৎ উষ্ণ পানি দ্বারা গোসল দিয়ে গা, হাত, পা মুছে কাঁথা
বা কম্বল দ্বারা আবৃত করে কোলে নিবেন এবং কোন পুরুষ লোক দ্বারা সেই শিশুকে মহল্লার
কোন বুযুর্গ আলেম, ইমাম বা কোন নেক লোকের কোলে দিবেন। তিনি স্বল্প আওয়াজে তার ডান
কানে আজান শুনাবেন এবং বাম কানে ইকামত শুনাবেন। ভূমিষ্ঠ সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে
হোক উভয়ের ক্ষেত্রেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত বলা
সুন্নাত।
হযরত
আবু রাফে (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখেছি যে, তিনি
হাসান ইবনে আলীর কানে আজান দিলেন-যখন তিনি মা-ফাতিমার ঘরে ভূমিষ্ঠ হন। আর ঐ আজান
নামাযের আজানের মতই ছিল। (জামি-তিরমিযী ও সুনামে আবু দাউদ)
2. তাহনীক করা অর্থাৎ কোন বুযুর্গ দ্বারা মধু
অথবা তার বদলে খুরমা কিংবা অন্য কোন মিষ্টিদ্রব্য কোন বুযুর্গ দ্বারা চিবিয়ে লালার
রসের সাথে মিশিয়ে তা আঙ্গুল দ্বারা শিশুর মুখের ভিতরে তালুতে লাগিয়ে দেয়া এবং উক্ত
বুযুর্গ দ্বারা তার জন্য নেক দু আ করানো। (সহীহ-বুখারী ও সহীহ-মুসলিম)
3 সপ্তম দিবসে শিশুর মাথার চুল মুন্ডানো, অতঃপর চুল পরিমাণ
স্বর্ণ বা রুপা সদকা করা। আর তার নাম রাখা এবং আকীকা করা: শিশুর বয়স যখন সাতদিন
হবে, তখন পিতা-মাতার প্রতি কয়েকটি কাজ করণীয় হয়ে পড়ে-
ক) তার মাথার চুল মুন্ডিয়ে দেয়া।
খ) চুলের ওজনের পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপা অথবা তার মূল্য
গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে তাদের দ্বারা শিশুর জন্য দু‘আ করানো।
(জামি’-তিরমিযী)
গ) কোন নেককার আলেম বা বুযুর্গ দ্বারা দু’আ করিয়ে
শিশুর ভাল ইসলামী নাম রাখা।(সুনান-আবু দাউদ)
ঘ) তার জন্য আকীদা করা। হযরত সালমান ইবনে আমের (রা) বলেন
–আমি রাসূলে কারীম (সা)কে একথা বলতে শুনেছি, “সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে, আক্কীকা করতে
হবে। সুতরাং তার পক্ষ থেকে পশু যবেহ করো এবং তার থেকে কষ্ট (অর্থাৎ তার
মাথার চুল) দূর করো।” (সহীহ বুখারী)।
আকীকা হিসেবে ছেলে হলে দু’টি এবং মেয়ে হলে একটি বকরী
বা খাসী যবেহ করা সুন্নাত। সংগতি কম থাকলে, ছেলেও জন্যও একটি বকরী যবেহ করা যায়।
অথবা যদি কোন অসচ্ছল ব্যক্তি একেবারেই আক্বীকা না করেন, তবে তাতে কোন গুনাহ হবে
না। কেননা, এটা সামর্থবানদের জন্য সুন্নাত।
আকীকার গোশত আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী ও
গরীব-দুঃখীদেরকে খাওয়ায়ে তাদের থেকে শিশুর জন্য দু’আ নিবে। যাতে শিশু দীর্ঘজীবী
হয়, সুস্থ থাকে, সচ্চরিত্রবান ও নেকবখত হয়। আকীকার গোশত কাঁচাও বিতরণ করা যায়,
আবার রান্না করেও খাওয়ানো যায়। সন্তানের মা-সহ পরিবারের সবাই আকীকার গোশত খেতে
পারবেন। তা কুরবানীর গোশতের মতই।
বকরীর পরিবর্তে গরু যবেহ করলেও তাও জায়িয আছে।
অধিকন্তু গরুতে 7টি ছাগলের হিসাব ধরে আক্বীকা পূর্ণ করা যায়। আবার এভাবে হিসেব করে
কুরবানীর সাথেও আক্বীকা দেয়া যায়।
4. শিশুকে দ্বীনী শিক্ষা দেয়া এবং আমলদার করে গড়ে
তোলা। উপযুক্ত হলে তার বিবাহের ব্যবস্থা করা: শিশুর বয়স যখন পাঁচ বৎসর হবে,
তখন শিশুকে কোন নেক বুযুর্গ আলেম দ্বারা দু’আ করিয়ে দ্বীনী শিক্ষা লাভের জন্য
মক্তবে পাঠাতে হবে। কারণ, শৈশবেই যদি শিশুকে দ্বীনী শিক্ষা ও দ্বীনী তরবিয়াত দেয়া
না হয়, তাহলে পরে আর সন্তানের সুচরিত্র গঠন সম্ভব হয়ে উঠে না। কথায় বলে, “কাঁচায়
না নোয়ালে বাঁশ, পাঁকলে করে ঠাস ঠাস”। অর্থাৎ কচি বয়সে শিশুকে ধর্ম-কর্ম শিক্ষা দিয়ে দ্বীনদানরূপে গড়ে
না তুললে, পরবর্তীতে তাকে সচ্চরিত্রবান ও দ্বীনদার বানানো দুরূহ হয়ে যায়।
ছেলে বা মেয়ের বয়স যখন 7 বৎসর হবে,
তখন হতে ছেলে-মেয়েদেরকে নামাযের অভ্যাস করাতে হবে। আর 10 বৎসর
বয়সের মধ্যে নামায ও অন্যান্য সকল আমলে পূর্ণ অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে এ
সময় কঠোরতা বা কিছুটা প্রহার করে শাসন করে হলেও তাকে নামায ও দ্বীনদারীতে
পূর্ণরূপে অভ্যস্ত করতে হবে। আর এ বয়স থেকেই তাদের বিছানা পৃথক করে দিতে হবে।
এ
সকল বিষয় শিশু-সন্তানের হক। তাদের এ হক আদায় হলে, তারা দ্বীনদার হিসেবে গড়ে উঠবে
এবং মা-বাবার পরকালীন সাফল্যের ওসীলা হবে।
.......মাওলানা
রুহুল আমীন যশোরী।